বন্ধুর বৌদির সাথে করলাম মন ভরে💥


 বন্ধুর বৌদির সাথে করলাম মন ভরে💥


সকালের ঘুম ভাঙতেই টের পেলাম, সমিরদের বাড়ি একেবারে ফাঁকা। বিয়েবাড়িতে সবাই চলে গেছে—শুধু বৌদি রয়েছেন, রান্নার জন্যে। কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে গেটের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়লাম। বারান্দা দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ এক অদ্ভুত হাসির শব্দ পেলাম।

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কান পাততেই বুঝলাম, ভেতরে কিছু হচ্ছে। জানালার পাল্লা একটু সরাতেই চোখ আটকে গেল।

যা দেখলাম, তা এক কথায় অপ্রত্যাশিত—মনে হলো, কেউ যেন ছেলেমানুষী খেলা খেলছে, কিন্তু তার রূপটা ছিল অনেক বেশি জটিল।

ভেতরে, রান্নাঘরের মেঝেতে বসে আছেন বৌদি। পরনে সাধারণ একটা শাড়ি। তাঁর সামনে সাজানো রয়েছে রান্নার মশলার কৌটোগুলো। হলুদের কৌটো, লঙ্কার গুঁড়োর কৌটো, জিরের কৌটো—সবগুলো যেন তাঁর খেলার সঙ্গী।

বৌদি একটা লঙ্কার গুঁড়োর কৌটোর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলছেন, "সারাদিন শুধু এটা করো, ওটা করো! আমার কি নিজের কোনো ইচ্ছে থাকতে পারে না?"

তারপর নিজেই ফিক করে হেসে ফেললেন। এবার হলুদের কৌটোটা হাতে নিয়ে, আদুরে গলায় বললেন, "ওমা, তাই বুঝি? কী ইচ্ছে শুনি তোমার? আকাশে উড়তে চাও?"

আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বৌদি একা একাই কথা বলছেন, নিজেই প্রশ্ন করছেন, আবার নিজেই উত্তর দিচ্ছেন। তাঁর মুখের অভিব্যক্তি মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে যাচ্ছিল—কখনও অভিমান, কখনও রাগ, আবার কখনও একরাশ ক্লান্তি। এটা কোনো ছেলেমানুষী খেলা ছিল না; এটা ছিল জমে থাকা কথার বিস্ফোরণ। যে কথাগুলো তিনি হয়তো কখনও কাউকে বলতে পারেননি, সেই কথাগুলোই আজ জড়বস্তুগুলোর সাথে ভাগ করে নিচ্ছেন। তাঁর হাসিটা আনন্দের ছিল না, ছিল এক গভীর যন্ত্রণার প্রকাশ।

আমার অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। সেই শব্দে বৌদির খেলা থেমে গেল। তিনি চমকে উঠে দরজার দিকে তাকালেন। জানালার ফাঁক দিয়ে আমার চোখাচোখি হতেই তাঁর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। লজ্জায়, অপমানে তাঁর কান দুটো লাল হয়ে উঠল।

আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ছুটে পালাব, নাকি ভেতরে যাব? মনস্থির করে ফেললাম। পালানোটা কাপুরুষতা হবে।

আমি ধীর পায়ে রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বৌদি পাথরের মতো বসে আছেন, চোখ নামানো। ঘরের নিস্তব্ধতা এতটাই ভারী যে, আমাদের দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছিল।

আমিই প্রথম কথা বললাম, খুব শান্তভাবে, "জল খাব।"

বৌদি কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়িয়ে গ্লাস বাড়িয়ে দিলেন। তাঁর হাত কাঁপছিল।

জল খাওয়া শেষ হলে আমি বললাম, "মাঝে মাঝে কথাগুলো এভাবে বের না করলে দম আটকে আসে, তাই না বৌদি?"

আমার এই একটা কথাতেই যেন বাঁধ ভেঙে গেল। বৌদির চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে শুরু করল। তিনি আঁচলে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। একজন বিবাহিত মহিলার ব্যক্তিগত মুহূর্তে ঢুকে পড়ে আমি তাঁকে কতটা আঘাত করেছি, সেটা ভেবে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল।

কিছুক্ষণ পর কান্না থামিয়ে তিনি ভাঙা গলায় বললেন, "তুমি... তুমি সব শুনেছ?"

আমি মাথা নাড়লাম। "ভেতরে আসুন," বলে তিনি বসতে ইশারা করলেন।

সেই ফাঁকা বাড়িতে, রান্নাঘরের মেঝেতে বসে আমরা দুজন কথা বলতে শুরু করলাম। বৌদি তাঁর জীবনের গল্প বললেন—এক এমন সংসারের গল্প, যেখানে তাঁর মতামত বা ইচ্ছের কোনো দাম নেই। সবাই তাঁকে ভালোবাসে, যত্ন করে, কিন্তু কেউ তাঁর মনের খবর রাখে না। তাঁর স্বামী, আমার বন্ধুর দাদা, মানুষটা ভালো হলেও বড্ড বেরসিক আর নিজের জগৎ নিয়ে ব্যস্ত। সারাদিনের একঘেয়েমি আর নিঃসঙ্গতা কাটাতে এভাবেই তিনি নিজের সাথে কথা বলেন। মশলার কৌটোগুলোই তাঁর একমাত্র বন্ধু।

আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম। যে বৌদিকে সবসময় হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল দেখেছি, তাঁর ভেতরে এত গভীর একাকিত্ব লুকিয়ে আছে, তা কখনও কল্পনাও করিনি।

আমাদের মধ্যে কোনো শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয়নি, কিন্তু সেই দুপুরে এক অদ্ভুত মানসিক বন্ধন তৈরি হয়েছিল। আমরা একে অপরের গোপন কথার সাক্ষী হয়েছিলাম। তিনি তাঁর যন্ত্রণার কথা উজাড় করে দিয়েছিলেন, আর আমি হয়েছিলাম তাঁর নীরব শ্রোতা।

বিকেল নাগাদ যখন বাড়ির সবাই ফিরতে শুরু করল, আমরা আবার স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। আমি বাড়ি ফিরে এলাম, কিন্তু আমার ভেতরটা তোলপাড় করছিল।

এরপর সমিরদের বাড়ি গেলেও বৌদির সাথে আমার আচরণ বদলে গিয়েছিল। আমরা চোখে চোখে কথা বলতাম। সেই চাহনিতে থাকত এক গোপন ইশারা—এক shared secret-এর ভরসা।

সেই ‘ছেলেমানুষী’ খেলার আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক জটিল, নিঃসঙ্গ মনের হদিস আমি পেয়েছিলাম। আর সেই গোপন কথার সাক্ষী ছিলাম শুধু আমি আর ওই ফাঁকা বাড়িটা। আমাদের সম্পর্কটা কোনো সংজ্ঞায় ফেলা যাবে না, কিন্তু তা ছিল অপ্রত্যাশিতভাবে গভীর আর পবিত্র।

মন্তব্যসমূহ